" পদব্রজে তিন কেদারনাথ ধাম "
পাহাড়ের ঘুরতে যেতে সব বাঙালীই খুব ভালোবাসে ,আর সেই ঘোরাটা যদি হয় পায়ে হেঁটে তাহলে তা আনন্দের অন্য মাত্রা যোগ করে । এবছর দুর্গাপূজোর অষ্টমীর দিন " টিম রোডিস " র ব্যবস্থাপনায় আমরা চললাম তিন কেদার ট্রেকিং করতে । ট্রেনে শিয়ালদহ-নিউ দিল্লি-হরিদ্বার হয়ে সেখান থেকে গাড়িতে তিনশো কিলোমিটারের বেশি পথ অতিক্রম করে বদ্রীনাথ ধাম । চার ধামের রাস্তা সম্প্রসারণের কাজ চলার কারণে যানবাহনের গতি খুবই শ্লথ । সেই কারণে সকাল বেলা হরিদ্বার থেকে রওনা হয়েও আমরা বদ্রীনাথ ধাম পৌঁছালাম রাত্রি দেড়টার সময় । সে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা । পরের দিন সকালে বদ্রীবিশাল জি কে দর্শন করে সেখান থেকে গাড়ি তে যোশীমঠ- হেলং-উরগাঁও র রাস্তা ধরে দেব গ্রাম পৌঁছালাম । পথের সৌন্দর্য অবর্ণনীয় । ঈশ্বরের নিজের হাতে সাজানো এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে দু চোখ ভরে দেখতে থাকলাম ।
প্রতিটা মুহূর্তই যেন এক একটা মনোমুগ্ধকর সবুজ পটভূমি। চারিদিকে শুধু পাইন, দেওদার, রডড্রেনডন আরো অন্যান্য গাছের মেলা। দেব গ্রাম থেকে পায়ে হাঁটা পথে এক কিলোমিটার দূরে গভীর অরণ্যের মধ্যে কল্পগঙ্গা নদীর ধারে পঞ্চকেদারের অন্যতম কল্পেশ্বরজির অবস্থান। মহাদেবের জটার অংশটি পড়েছিল এখানে । সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ। মন্দিরের প্রবেশপথের কাছেই এক সুন্দরী ঝর্ণা প্রবল শব্দে ঝাঁপিয়ে পড়ছে কল্পগঙ্গা নদীর বুকে।দেব গ্রাম থেকে রুদ্রনাথ চল্লিশ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ । তিন দিনে অতিক্রম করতে হবে এই পাহাড়ি পথ এই লক্ষ্য নিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করলাম। প্রথমেই শুরু হলো চড়াই পথ । সবুজ গাছের ছায়া পথ ধরে বনের কীটপতঙ্গ ও পাখিদের মিষ্টি গলার সুরের ধ্বনি শুনতে শুনতে আমরা উপরে উঠতে থাকলাম । ইন্দ্রীয়দের সজাগ রেখে সতর্কতার সাথে এগোতে হচ্ছে সবাইকে। পথ খুবই বীপদশঙ্কুল। চড়াই পথে উঠতে উঠতে এক সময় পাহাড়ের চূড়াতে পৌঁছে গেলাম । পথ এখনো অনেক বাকি।
আজ আমাদের গন্তব্য ডুমাক। এবার আমাদের সতর্কতার সাথে উৎরাই পথে নামতে হবে। চোখ ও মন কে প্রকৃতির রসে সিক্ত করে ধীরে ধীরে এগোতে থাকলাম । এইভাবে বেশ কিছুটা চলার পরে কোলগোট গ্রামে পৌঁছে দুপুরের খাবার খেয়ে প্রথম দিনের আঠারো কিলোমিটার রাস্তার বাকি সাত কিলোমিটার অতিক্রম করার লক্ষ্যে এগোতে থাকলাম। পাগল করা পথের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে কখন যে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে খেয়াল করিনি । প্রাক কোজাগরী পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় আলোকিত বনভূমির অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে দেখতে কৃত্রিম আলোয় পথ চিনে এক সময় পৌঁছে গেলাম ডুমাক গ্রামে ।
পরের দিন সকালে রওনা হলাম চোদ্দ কিলোমিটার দূরে পানারের উদ্দেশ্যে।যাত্রার শুরুতেই পথপ্রদর্শক স্মরণ করিয়ে দিল " পানার কি চড়াই, জার্মান কি লড়াই "।মনের ভিতরে একটা উদ্বেগ কাজ করলেও মন কে বোঝাতে থাকলাম তোমাকে পারতেই হবে । দুই কিলোমিটার পথ ছোট ছোট আলগা পাথরের উপর দিয়ে উৎরাই পথে পৌঁছে গেলাম এক সুন্দরী ঝর্ণার কাছে । সে যেন এক প্রান চঞ্চলা নারী । হৃদয় ছুঁয়ে কানে কানে বলে ,ওহে প্রিয় দেখা হবে কথা হবে তোমার সাথে আবার । প্রকৃতির এই সৌন্দর্য কে উপভোগ করতে করতে হৃদয়ে তার স্পর্শ নিয়ে বিভিন্ন বুগিয়ালের ও রূপসী ঝর্ণার রূপে মুগ্ধ হয়ে, মনের অদম্য ইচ্ছা শক্তির জোরে চড়াই পথের বাঁধা কে অতিক্রম করে আমরা এগোতে থাকলাম । পথ যেন আর শেষ হয়না ।
পূর্ণিমার আলোয় মায়াবিনী পাহাড়ের সৌন্দর্য দুচোখ ভরে দেখতে দেখতে দীর্ঘ পানার বুগিয়াল অতিক্রম করে পৌঁছে গেলাম পানারে । রুদ্রনাথজির কাছে পৌঁছাতে আর মাত্র আট কিলোমিটার পথ বাকি। মনের মধ্যে একটা উত্তেজনা কাজ করছে তাকে দেখার জন্য। পরের দিন সকালে রওনা হয়ে পিত্রধার পর্যন্ত চড়াই পথে চলার পরে বাকি পথ চড়াই উতরাই পথে এগোতে এগোতে কোন এক নাম না জানা পাহাড়ের বাঁক থেকে দেবদর্শন (মন্দির) সম্ভব হলো। তখনো অনেক পথ বাকি। দেবতার আকর্ষণে সমস্ত রকম বাঁধা কে অতিক্রম করে পৌঁছে গেলাম রুদ্রনাথজির মন্দিরে। ভক্তিভরে প্রণাম করে এক নিমেষে মনের সব সুখ দুঃখের কথা তার সাথে ভাগ করে নিয়ে সন্ধ্যা আরতির অপেক্ষায় থাকলাম। তাঁর রূপ দেহ ও মনকে শিহরিত করছিল। মহিষরূপি শিবের মাথার অংশটি এখানে পূজো করা হয় ।
পরের দিন সকালে রওনা হলাম নেওলা পাস অতিক্রম করে অনুসূয়া উদ্দেশ্যে এবং সেখান থেকে মণ্ডল গ্রামে । এই তেইশ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ আমরা দুই দিনে অতিক্রম করবো । ভয়ঙ্কর সুন্দর বলতে কি বোঝায় তা একমাত্র বোঝা সম্ভব নেওলা পাসে এলে । একজন মানুষের পক্ষে চলা সম্ভব এইরকম পথের একপাশে পাহাড় অন্য পাশে হাজার হাজার ফুট গভীর খাদ । মনের জোর হারালেই বিপদ অবশ্যম্ভাবী ।
সারাটা পথ নন্দাদেবী রেঞ্জের নন্দাদেবী, নন্দাঘুন্টি, ত্রিশূল, চৌখাম্বা মতো শ্বেতশুভ্র বরফের চাদরে মোড়া চূড়াগুলো আমাদের চলার পথের সঙ্গী। নেওলা পাসের পাশর্বর্তী এলাকা তৃণভূমি অঞ্চল । উৎরাই পথে বেশ কিছুটা নামার পর ঘন অরণ্য ।
আগের দিনের বৃষ্টির কারণে কর্দমাক্ত ও ঝরা পাতার পিচ্ছিল পথে সতর্কতার সাথে এগোতে হচ্ছে । এইভাবে বিভিন্ন বুগিয়াল কে স্পর্শ করে অনুসূয়া পৌঁছে সেখান থেকে পরের দিন মণ্ডলে পৌঁছালাম । পরের দিন সকালে মণ্ডল গ্রাম থেকে গাড়িতে চোপতায় পৌঁছালাম। চোপতার পথে পাহাড়ি হরিণ (থর) দেখার অভিজ্ঞতাও ভোলার নয় ।চোপতা থেকে রওনা হলাম পাথর বাঁধানো সুন্দর রাস্তা ধরে তুঙ্গনাথের উদ্দেশ্যে। পুরোটাই চড়াই পথ। পথের বেশ কিছুটা অংশ সবুজ গাছের ছায়ায় ঘেরা বাকি অংশ ঘাসের ভেলভেটের চাদরে মোড়া। তুঙ্গনাথ প্রায় 3700 মিটার উঁচুতে অবস্থিত ।
পৃথিবীর সব থেকে উঁচুতে অবস্থিত শিবমন্দির হওয়ার কারণে এখানে ঠান্ডাও প্রচন্ড। মহিষরূপী শিবের বাহুর অংশটি এখানে পূজিত হয় । চড়াই পথে একসময় পৌঁছে গেলাম বাবার কাছে। মন্দিরের প্রাঙ্গণ থেকে দেখা চারিদিকের অপরূপ নৈসর্গিক দৃশ্য দেখে মনপ্রাণ প্রসন্ন হয়ে গেল । তুঙ্গনাথ থেকে বেশ কিছুটা উঁচুতে প্রায় 4000 মিটার উচ্চতায় চন্দ্রশীলা থেকে দেখা সূর্যোদয়ের অভিজ্ঞতাও খুবই মনোরম । তুঙ্গনাথ অঞ্চলে মোনাল পাখি দেখার অভিজ্ঞতাও এক পরম প্রাপ্তি ।এবার আমাদের ঘরে ফেরার পালা ।
পার্থ সারথী মণ্ডল
ঘোষ পুকুর লেন
সেগুন বাগান
পোস্ট কৃষ্ণনগর জেলা নদীয়া
মোবাইল নাম্বার 7001323045
কিভাবে যাবেন :- ট্রেনে হরিদ্বার পৌঁছে সেখান থেকে গাড়িতে উরগ্রাম উপত্যকার কল্পেশ্বর পৌঁছে বাকি পথ পায়ে হেঁটে ।
কোথায় থাকবেন:- কল্পেশ্বর, ডুমাক ও অনুসূয়াতে বেশ কিছু হোম স্টে আছে । মণ্ডল,চোপতা ও তুঙ্গনাথে প্রচুর হোটেল আছে । পানার ও রুদ্রনাথে থাকার জায়গা সীমিত ।
Photo Gallery :
কোন মন্তব্য নেই