" সান্দাকফু ভ্রমণ "
" সান্দাকফু ভ্রমণ "
প্রত্যেক বাঙালিই ঘুরতে ভালোবাসেন । সবাই চেষ্টা করে সাধ্যের মধ্যে সাধ পূরণের । এই ভালোবাসা কে সঙ্গী করে সবাই ঘুরতে যায় পাহাড়ে অথবা সমুদ্রে । পাহাড়কে ভালোবেসে মনকে আনন্দ দিতে নভেম্বর মাসের পনেরো তারিখে আমরা দশজন বেরিয়ে পড়লাম টংলু -সান্দাকফু - ফালুট - লেপচাজগতের উদ্দেশ্যে ।
হাওড়া থেকে সরাইঘাট এক্সেপ্রসে রওনা হয়ে মাঝরাতে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে পৌঁছে সেখান থেকে ভোর বেলা গাড়িতে রওনা হলাম মানেভঞ্জনের উদ্দেশ্যে । শিলিগুড়ি শহরের পাশে মহানন্দা নদীর সেতু অতিক্রম করে আমরা এগোতে থাকলাম । হিমেল হাওয়ায় কারণে সবার মন প্রাণ জুড়িয়ে গেল । ভোরের আলোয় আশেপাশের সমস্ত কিছুই বেশ মায়াবি লাগছিল । ফাঁকা রাস্তা দিয়ে দ্রুত এগোতে থাকলো আমাদের গাড়ি ।
বেশ কিছুটা পথ যাওয়ার পর আমরা পাহাড়ে উঠতে শুরু করলাম । রোহিণীর রাস্তার ধারের বা আশপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দার্জিলিং পৌঁছানোর অন্য রাস্তা গুলোর তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম । পাহাড়ি সর্পিল আঁকাবাঁকা পথের ধারের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আমরা পৌঁছে গেলাম কার্শিয়াং এ ।
পাহাড়ের মানুষের তখনো ঘুম ভাঙ্গেনি ,দোকান বাজার সব বন্ধ । সোনাদা, ঘুম, লেপচাজগৎ, সুকিয়া পোখরি হয়ে সকাল সাতটার সময় পৌঁছে গেলাম মানেভঞ্জনে । সেখান থেকে সিঙ্গলিলা পার্কে প্রবেশের অনুমতিপত্র নিয়ে বোলেরো গাড়িতে আমরা রওনা হলাম টংলুর উদ্দেশ্যে । রাস্তার দুই পাশে পাইনের বন ,তারা যেন আমাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য দাঁড়িয়ে আছে । খুব সুন্দর ও মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে সম্পূর্ণ চড়াই পথে আমরা পৌঁছালাম চিত্রে উপত্যকায়। চারদিকে রাশি রাশি মেঘ ভেসে চলেছে এক অচেনা অজানা পথে নাম না জানা কোন ঠিকানায় । আমাদের মনের মধ্যে সংশয় কাজ করছে, বারবারই মনে হচ্ছে ঘুমন্ত বুদ্ধ কে চাক্ষুষ করতে পারবোতো ? যদিও আমাদের সারথী এই ব্যাপারে আশ্বস্ত করলো আমাদেরকে । মেঘের পালকের ডানায় ভর করে আমরা এগোতে থাকলাম ।
যত উপরে উঠতে থাকলাম আকাশ তত পরিষ্কার হতে আরম্ভ করলো । একসময় আমরা পৌঁছালাম টংলুতে । পরিষ্কার আবহাওয়া, চোখের সামনে শ্বেতশুভ্র বরফের চাদরে মোড়া কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতশ্রেনী । দূর থেকে দেখলে মনে হয় বুদ্ধদেব ঘুমিয়ে আছেন । এ যেন পটে আঁকা চিত্র । আমাদের একটাই কাজ, বহুকাঙ্ক্ষিত তার এই অপূর্ব রূপ নয়ন মেলে দেখা । অবস্থানগত ও স্হাপত্যগত সৌন্দর্যের কারণে টংলু ট্রেকার্স হাঁটের সৌন্দর্য যেন ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখা একখণ্ড মনোমুগ্ধকর ছবি । এখানকার ঘরে বসেই কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জের সমস্তটাই দেখা যায় ।
এক ধারে ছোট একটা জলাশয়, পাশ দিয়ে চলে গেছে বাঁধানো রাস্তা সান্দাকফুর দিকে। এখানকার তত্ত্বাবধায়কদের আতিথেয়তাও মনে রাখার মতো । পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই পাশের ভিউ পয়েন্ট থেকে সূর্যোদয় দেখতে ছুটলাম। ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে আলো আঁধারিতে দেখতে পাচ্ছিলাম চারিদিকে শুধু সাদা মেঘের সমুদ্র । সে যেন অপেক্ষায় রয়েছে আমরা কখন ঝাঁপিয়ে পড়বো তার বুকেতে ।সূর্যের রশ্মির প্রথম আলোয় আলোকিত কাঞ্চনজঙ্ঘার রক্তিম রূপের দৃশ্য সকলের কাছে ছিল এক অপার্থিব অনুভূতি । টংলু থেকে যাত্রা শুরু করে আমরা এগিয়ে চললাম সান্দাকফুর উদ্দেশ্যে । পথে পরবে টুমলিং, গৌরিবাস, কালীপোখরি । এই পথে চলার আনন্দ বেশ মজার ।
আন্তর্জাতিক সীমান্ত অতিক্রম করে কখন আমরা নেপালে ঢুকে পড়ছি আবার কখন নিজেদের দেশে থাকছি তা বোঝা মুশকিল । সান্দাকফু তে আমরা থাকতাম ভারতবর্ষে আর খেতে যেতে হতো নেপালে । চলার পথে এইরকম ঘটনা বারবার ঘটেছে । যদিও সশস্ত্র সীমা বলের দ্বারা যাত্রীদের পরিচয় পরীক্ষা করা দেখে কখনোই মনে হয়নি আন্তর্জাতিক সীমান্ত অতিক্রম করা এতো সহজ । মানেভঞ্জন থেকে গৌরিবাস পর্যন্ত খুব সুন্দর বাঁধানো রাস্তা । কিছু কিছু জায়গায় রাস্তার পাশের বাঁধানো অংশ কে দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন "চিনের প্রাচীর"। রাস্তার দুই পাশে বিভিন্ন রকমের রডড্রেনডন , পাইন, বাঁশ গাছের প্রজাতির ছোট ছোট গাছ ও নাম না জানা আরো গাছের জঙ্গল । জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে মাঝে মাঝেই উঁকি দিচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জের কুম্ভকর্ণ, কুম্ভকর্ণ পূর্ব ,রাথাং,উত্তর ও দক্ষিণ কাবরু, কাবরু ডোম, কাঞ্চনজঙ্ঘা, মাউন্ট পাণ্ডিম প্রভৃতি শৃঙ্গগুলি । গৌরিবাসের পর থেকে রাস্তা খুবই খারাপ হওয়ার কারণে গাড়ি চলছিল হরিণ ছানার মতো লাফিয়ে লাফিয়ে । প্রকৃতির সৌন্দর্যে আনন্দ উপলব্ধির সাথে সাথে শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করাও বেশ কষ্টকর হচ্ছিল সবার কাছে ।
কালীপোখরি তে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র জলাশয় ছুঁয়ে বিকাল বেলা আমরা পৌঁছালাম সান্দাকফু তে । 3636 মিটার উচ্চতায় অবস্থিত সান্দাকফু পশ্চিমবঙ্গের সব থেকে উঁচু জায়গা । এখানকার নয়নাভিরাম সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ সবাই কে হতেই হবে । এই জায়গা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জকে আরো কাছ থেকে দেখা যায়। দূরের মাউন্ট এভারেস্ট ,লোৎসে ও তার আশেপাশের শৃঙ্গগুলিও এখান থেকে দেখা যায় । সান্দাকফু থেকে সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয় দেখাও এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি । সূর্যোদয়ের সময় মনে হচ্ছিল সূর্যনারায়ণ মেঘের পাশ থেকে চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে উদয় হচ্ছে । সান্দাকফু তে এক রাত কাটিয়ে পরবর্তী গন্তব্য ফালুটের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম । একুশ কিলোমিটার পথ কিন্তু পথের দুর্গমতার কারনে এই সামান্য পথ অতিক্রম করা বেশ কষ্টসাধ্য । পথের দু পাশের সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন । কিছুটা পথ যাওয়ার পর চান্দু বুগিয়ালে সকালের প্রাতরাশ খেয়ে তান্দু লেকের পাশে আরো কিছুটা সময় কাটিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম ফালুটের উদ্দেশ্যে । সান্দাকফু ও ফালুট প্রায় একই উচ্চতায় অবস্থিত হলেও ফালুটের কাছের বেশির ভাগ পাহাড় তৃণ আচ্ছাদিত ।
একসময় আমরা পৌছে গেলাম আমাদের গন্তব্যে । খুব সুন্দর ট্রেকার্স হাট কিন্তু এখানে কোন বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা নেই । রাতের নিকষ কালো অন্ধকার দূর করতে একমাত্র মোমবাতির আলোয় ভরসা । সারারাত বেশ একটা ভৌতিক পরিবেশের মধ্যে কাটিয়ে ভোর বেলা রওনা হলাম ফালুট ভিউ পয়েন্টের উদ্দেশ্যে । এক কিলোমিটারের বেশি চড়াই পথ অতিক্রম করে লক্ষ্যে পৌঁছে মনে হলো হাত বাড়ালেই কাঞ্চনজঙ্ঘা শ্রেণী কে ছুঁতে পারবো ।
নিজের চোখকে কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না এই মুহূর্তকে । মেঘমুক্ত আকাশে এখান থেকে এভারেস্ট শৃঙ্গকেও খুব পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল । কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সূর্যোদয়ের সৌন্দর্য কে উপভোগ করে আমরা ফিরে এলাম । আজকে আমাদের যেতে হবে বাহান্ন কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে প্রথমে মানেভঞ্জনে তারপর আরো এগারো কিলোমিটার গিয়ে লেপচাজগতে ।
উৎরাই পথের বেশির ভাগ অংশই দুর্গম হওয়ার কারণে এই যাত্রা পথ ছিল বেশ কষ্টকর। দার্জিলিং র খুব কাছে শান্ত নিরিবিলি পরিবেশে পাহাড়ি গ্রাম লেপচাজগৎ । বেশিরভাগ সময় মেঘের চাদরে অথবা কুয়াশা মোড়া থাকে এই গ্রাম ।
আবহাওয়া পরিষ্কার থাকলে এখানকার ভিউ পয়েন্ট থেকেও কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতশ্রেণী কে খুব ভালো ভাবে দেখা যায় । এখানকার হোম স্টে মালিকদের আতিথেয়তা ও ব্যবহার মনে রাখার মতো । কুড়ি তারিখ দুপুরে আমরা মিরিকের দিকের রাস্তা দিয়ে রওনা হলাম নিউ জলপাইগুড়ির স্টেশনের উদ্দেশ্যে । অপরূপ পথের সৌন্দর্য , রাস্তার দুই পাশে পাইনের বন অথবা সবুজ কার্পেটের গালিচা বিছানো চা বাগান । মিরিক লেক ও তার আশেপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যোও খুব সুন্দর । এবার আমাদের ঘরে ফেরার পালা |
পার্থ সারথী মণ্ডল
ঘোষ পুকুর লেন
সেগুন বাগান
পোস্ট কৃষ্ণনগর জেলা নদীয়া
মোবাইল নাম্বার 7001323045
কিভাবে যাবেন:- হাওড়া বা শিয়ালদহ থেকে যেকোনো ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি / বাসে শিলিগুড়ি পৌঁছে সেখান থেকে গাড়িতে মানেভঞ্জন । মানেভঞ্জন থেকে গাড়ি তে অথবা হেঁটে যেতে হবে ।
কোথায় থাকবেন:- টংলু, সান্দাকফু ও ফালুটে ট্রেকার্স হাট আছে এবং টুমলিং, গৌরিবাস, কালীপোখরি ও সান্দাকফু তে বেশকিছু হোটেল আছে।
কোন মন্তব্য নেই