সুন্দরবন ভ্রমণ
কথায় আছে ‘জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ’। যেমন সুন্দর, তেমনই বিপদ সঙ্কুল এই অরণ্য । এখানে নদী নালা ও নোনতা জলের খাঁড়িতে অজস্র কুমির ঘুরে বেড়াচ্ছে আর বনের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের পশু যাঁর মধ্যে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার উল্ল্যেখযোগ্য । গর্জন,গরান ,কেওরা ,সুন্দরী,বাইন, ধুধুল, হেতাল, কাঁকড়া, খলসে, পশুর, গেঁও,হোগলা গাছের জঙ্গলে ও বিভিন্ন নদী দিয়ে ঘেরা সুন্দরবন ঘোরার ও সেখানকার পশু পাখিদের দেখার ইচ্ছে নিয়ে মনের অপূর্ণ ইচ্ছা পূরণ করার লক্ষ্যে ডিসেম্বর মাসের শেষ তিন দিন ঘুরে এলাম পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণে অবস্থিত দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার অন্তর্গত ঝড়খালি থেকে সুন্দরবনের কিছু অংশ ।
কৃষ্ণনগর থেকে সকাল ছটার ট্রেনে রওনা হয়ে শিয়ালদহ পৌঁছে শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখা থেকে ক্যানিং লোকালে ক্যানিং পৌঁছে সেখান থেকে পূর্ব নির্ধারিত গাড়িতে এক ঘন্টার কিছু বেশি সময় চলার পর কুলতলি ও বাসন্তী কে ছুঁয়ে প্রায় পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে আমরা পৌঁছালাম ঝড়খালি । খুব ছোট একটা গঞ্জ হলেও ভ্রমণাথীর্দের ভীড়ে বেশ জমজমাট হয়ে রয়েছে সমস্ত এলাকা । আমাদের নির্দিষ্ট হোটেলে জিনিসপত্র রেখে দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা রওনা হলাম "টাইগার রেসকিউ সেন্টারে " র পথে । একটা সুদৃশ্য পার্কের মধ্যে এই রেসকিউ সেন্টারটি অবস্থিত । দুটো পূর্ণ বয়স্ক রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার কে তাদের শারীরিক অসুবিধার কারণে এখানে রাখা হয়েছে । এছাড়াও রয়েছে একটা সুন্দর প্রজাপতি পার্ক , কুমিরদের থাকার জন্য সুন্দর ব্যবস্থা । এরপর ফেরি ঘাটে কিছুটা সময় কাটিয়ে আমরা ফিরে এলাম । আগামীকাল সকাল থেকে শুরু হবে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছোট বড় দ্বীপের মধ্যে অবস্থিত বনভূমির সৌন্দর্য উপভোগ করা ।
পরের দিন সকালে মাতলা ও বিদ্যাধরী নদীর সংযোগকারী হেড়োভাঙ্গা নদীর ফেরি ঘাট থেকে আমরা আমাদের যাত্রা শুরু করলাম । লঞ্চের মধ্যেই সারা দিনের রান্নার ব্যবস্থা । নদীর দুই তীরের সবুজের সমারোহ দেখতে দেখতে আমাদের লঞ্চ বিদ্যাধরী নদীর মধ্যে প্রবেশ করলো । চারদিকে দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি কোন কূল কিনারা দেখা যাচ্ছে না, তার মধ্যে মোচার খোলার মতো ভেসে চলেছে আমাদের লঞ্চ । এই জায়গাটিকে "পঞ্চমুখী" বলে । গাইড প্রশান্তের কাছ থেকে জানতে পারলাম এখানে নদী প্রায় পাঁচ কিলোমিটার চওড়া । এই ভাবে জলপথে চলতে চলতে আমরা পৌঁছালাম সুধন্যখালিতে ।অজস্র বাঁদর আমাদের স্বাগত জানালো তাদের বাসভূমিতে । বনবিভাগের কর্মচারীরা দ্বীপের বেশ কিছুটা অংশ জাল দিয়ে ঘিরে সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে , বাকী অংশ বনের পশুদের জন্য উন্মুক্ত। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে ভ্রমণার্থীদের ভিরে পথ চলা দুষ্কর । এখানকার ওয়াচ টাওয়ারের উপর থেকে দেখা আশেপাশের বনভূমির ল্যাণ্ডস্কেপের সৌন্দর্য অতুলনীয় । এখানে বেশ কয়েকটি হরিণ কে সবুজের মাঝে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেল । দ্বীপের চারিদিকের নদী, নালা,খালের জল লবণাক্ত কিন্তু দ্বীপের মধ্যের জলাশয়ের জল মিষ্টি হওয়ার কারণে পশুপাখিরা এই সমস্ত জলাশয়ে জল খেতে আসে ।
এখানকার বনে যেমন বাঘ দেখতে পাওয়া যায় তেমনি নোনা জলে অজস্র কুমির দেখতে পাওয়া যায় । জীবিকার তাগিদে এখানকার মানুষদের এই বিপদ কে মোকাবিলা করেই মাছ ,কাঁকড়া ধরতে হয় অথবা বন থেকে মধু সংগ্রহ করতে হয় । পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন । বিপদের কথা বাদ দিলে, জল-জঙ্গলের অসাধারণ বৈশিষ্ট্যময় প্রকৃতি ও জীব-জন্তুর সমাহার যা প্রকৃতি প্রেমী ও পর্যটকদের কাছে এক স্বর্গরাজ্য। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের মনোরম আবহাওয়ায় লঞ্চের ডেকে বসে বিভিন্ন ধরনের নোনা জলের মাছ ভাজা খেতে খেতে জঙ্গলের কোর এলাকার মধ্যে দিয়ে আমরা এগোতে থাকলাম । সারাদিন জঙ্গলের প্রকৃতিকে উপভোগ ও উপলব্ধি করা আর উৎকন্ঠা ও উত্তেজনা নিয়ে দুপাশের জঙ্গলের দিকে একভাবে চেয়ে থাকা, যদি "দক্ষিণারায়ে"র দেখা পাওয়া যায়।যদিও চলার পথে নদীর চরে বিভিন্ন ধরনের কুমির বারংবার দেখা যাচ্ছিল । এখানকার ম্যানগ্রোভ ফরেষ্টের বৈশিষ্ট্য ঠেসমূল ,শ্বাসমূল । নদী অথবা খাঁড়ির মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় ঠেসমূলের সাহায্যে বিভিন্ন গাছের জোয়ার ভাটার সময় কাণ্ড কে সোজা রাখার প্রচেষ্টা অথবা শ্বাসমূলের সাহায্যে শ্বাস গ্রহণের কৌশল খুব সুন্দর । সুধন্যখালি থেকে জলপথে আমরা পৌঁছালাম সজনেখালি । একই রকম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য । এখানকার মিউজিয়ামটি খুব সুন্দর । সুন্দরবন সম্পর্কে সমস্ত রকমের বিষয়ে জানা যায় । জলবিহার করে এবার আমাদের ঝড়খালিতে ফিরতে হবে ।
তৃতীয় দিন সকালে তারাতারি সবাই প্রস্তুত হয়ে নিয়ে আমরা আবার পৌঁছে গেলাম ফেরিঘাটে । আজ আমরা প্রথমে যাবো দোঁবাকি ক্যাম্পে । হেড়োভাঙ্গা নদী দিয়ে বিদ্যাধরী নদীর মধ্যে পঞ্চমুখী অতিক্রম করে আমরা এগোতে থাকলাম । প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম দোঁবাকিতে । এখানকার বনভূমির উপর দিয়ে জাল দিয়ে ঘেরা প্রায় পৌনে এক কিলোমিটার দীর্ঘ ঢালাই করা রাস্তাটি খুবই সুন্দর । এই রাস্তা ও ওয়াচ টাওয়ারের উপর থেকে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের বনভূমি দেখার অভিজ্ঞতাও রোমাঞ্চকর । এখানকার মিষ্টি জলের জলাশয়ে প্রচুর পরিযায়ী পাখি মনের আনন্দে ভেসে বেড়াচ্ছিল । তার পাশেই বুনো শূয়রের দল জল খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল । বেশ কিছুটা সময় এখানে কাটানোর পর আমরা রওনা হলাম পীরখালির জঙ্গলের উদ্দেশ্যে । আগামী পাঁচ ঘন্টা আমাদের জলে জলেই কাটাতে হবে আর তাঁর (দক্ষিণরায় )অপেক্ষায় থাকতে হবে যদি তার দেখা পাওয়া যায় । প্রকৃতির রূপ, রস, গন্ধকে নয়ন ভরে দেখতে দেখতে ও উপলব্ধি করতে করতে নদী ও খাঁড়ি পথে আমাদের লঞ্চ ঘুরতে থাকলো পীরখালির জঙ্গলের ভেতর দিয়ে । হেতাল বনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বারংবার মনে হচ্ছিল এই বুঝি তাঁর দেখা পাবো । কিন্তু দীর্ঘক্ষণ ঘুরেও বিফল মনে ঝড়খালির উদ্দেশ্যে রওনা হতে হলো । ফেরার পথে পঞ্চমুখী অতিক্রম করার আগে নদীর চরে প্রচুর হরিণ কে তৃণভূমির মধ্যে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেল । এবার আমাদের বিদায়ের পালা । ঝড়খালি তথা সুন্দরবন কে বিদায় জানিয়ে আমরা রওনা হলাম বাড়ীর উদ্দেশ্যে ।
কোন মন্তব্য নেই