'মেঘ পাহাড়ের দেশ তিনচুলে'

     'মেঘ পাহাড়ের দেশ তিনচুলে'

        গুটিপোকা থেকে প্রজাপতি হয়ে ওড়ার মতই আনন্দের দিন 'আজ' আমাদের। একঘেয়ে জীবনের রোজনামচা থেকে মুক্তি পেতে জীবনে একটু নতুনত্বের অক্সিজেন তো চাই। লকডাউনের কারণে দীর্ঘ সময়ের বন্দি জীবন শেষ করে সাতাশে আগস্ট আমরা অফিসের পাঁচ সহকর্মী  শিলিগুড়ি থেকে সত্তর কিলোমিটার দূরে দার্জিলিং জেলার পাহাড়-নদী-জঙ্গলে ঘেরা তিনচুলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। নবদ্বীপ ধাম ষ্টেশন থেকে 'তোর্সা ফেস্টিভাল স্পেশালে' সওয়ারি হয়ে গোধূলি আলোয় ট্রেনের কামরার ভিতর থেকে শস্য শ্যামলা রূপসী সোনার বাংলার গ্রাম ও শহরের দৃশ্য দেখতে দেখতে এগোতে থাকলাম । 


        এরপর রাতের অন্ধকার চিরে ট্রেন চলতে থাকলো ।পরের দিন ভোরে নির্দিষ্ট সময়ে নিউ জলপাইগুড়ি ষ্টেশনে পৌঁছে, সেখান থেকে গাড়িতে রওনা হলাম তিনচুলের উদ্দেশ্যে।শিলিগুড়ি শহর ছাড়িয়ে কিছুটা যাওয়ার পর সুকনা ফরেস্টের মনোরম সবুজ পরিবেশের মধ্যে দিয়ে আমরা রোহিণী চেক পোস্টে পৌঁছালাম । এরপর পাহাড়ি চড়াই পথ দিয়ে কার্সিয়াং , সোনাদা, জোরবাংলো হয়ে  প্রকৃতির সৌন্দর্য কে সঙ্গী করে আমরা এগোতে থাকলাম । কার্সিয়াংর পর থেকে পাহাড়ের সৌন্দর্য আরো বেড়ে গেলো। পাহাড়ের প্রতিটা ইঞ্চি ওক ,পাইন,দেওদার,ফার্ণ ও অন্যান্য নানা প্রজাতির গাছ দিয়ে সাজানো ছায়ামাখা সবুজ পথ । অন্যদিকে দিগন্ত বিস্তৃত মেঘরাশি তার মাঝখানে সপার্ষদ কাঞ্চনজঙ্ঘা বিরাজমান । যদিও তার শিখরে আড়াল করা মেঘেদের আনাগোনা । চারদিকের প্রকৃতির এই সৌন্দর্য দেখে মনে হচ্ছে ঈশ্বর তার নিজের খুশিতে ও আনন্দে আমাদের জন্য ক্যানভাসে সব  মনোমুগ্ধকর  ছবি এঁকে রেখেছেন ,যা দেখে  আমাদের  চোখ ও মন  প্রতিনিয়ত  প্রফুল্ল হচ্ছে । 

        এইভাবে সর্পিল পথে এঁকে বেঁকে চলতে চলতে পাহাড়ের গায়ে বিভিন্ন প্রকারের অর্কিড ও ফুল দিয়ে সাজানো বাড়ীগুলোর সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছে গেলাম তিনচুলে নামক ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামে। চারদিকে সবুজের সমাহারের মাঝে হোম স্টে গুলো অবস্থিত। শান্ত, নিরিবিলি পাহাড়ি গ্রাম। যেখানে রয়েছে অপার শান্তি আর  নাম না জানা পাখিদের কলতান। মেঘ পাখি ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে পাইন বনের ভিতর দিয়ে আর সেখান থেকে ঝরে পড়ছে রাশি রাশি বৃষ্টির ফোঁটা। ঠিক এই ভাবেই আমাদের অভ্যর্থনা জানালো তিনচুলে। এই নির্জন পরিবেশে  বৃষ্টির এই মায়াবি রূপ দেখতে খুবই ভালো লাগছিল।প্রতি মুহুর্তে মেঘের পালকের স্পর্শের কারণে আমাদের প্রত্যেকেরই হৃদয় উচ্ছ্বসিত। দুপুরের পর থেকেই আকাশ পরিস্কার হতে শুরু করলো। হোম স্টে থেকে কিছুটা দূরে গুম্বাদ্বারা ভিউ পয়েন্ট। এখান থেকে ৩৬০ ডিগ্রি কোনে চারিদিকের পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। 


        এছাড়াও পাখির চোখে সিকিমের নামচি শহরের ও কালিম্পং শহরের ছবির মতো সাজানো ঘর বাড়িগুলোর সুন্দর দৃশ্য, রঙ্গিত ও তিস্তা নদীর বয়ে চলার দৃশ্য, তিস্তা নদীর উপর বাংলা, সিকিম সংযোগকারী মেল্লি ব্রিজকেও দেখা যায়। বিজলির আলোয় সেজে থাকা কালিম্পং শহরের মনোরম দৃশ্যও চমৎকার। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন হাজার হাজার জোনাকি একসাথে জ্বলে রয়েছে। পরের দিন ভোর বেলা পাখিদের কলতানে সবার ঘুম ভাঙ্গলো। গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বৃষ্টিস্নাত পাহাড়ের সৌন্দর্য অপলক দৃষ্টিতে উপভোগ করেই কেটেছিল, আজ সকাল শুরু হলো সূর্যোদয়ের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখার মধ্যে দিয়ে। শান্ত নিরিবিলি পরিবেশে হোম স্টে এর বারান্দায় বসে  সূর্যোদয়ের সাথে সাথে আকাশে রঙের খেলার মনোরম দৃশ্য কখনোই ভোলার নয়। প্রাতরাশ খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম এই ছোট্ট জনপদটিকে চেনার জন্য জানার জন্য। ঘন পাইন বনের ছায়াপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম তিনচুলে মনেস্ট্রি তে। অবস্থানগত কারণে জায়গাটি খুবই সুন্দর।



        যদিও কোভিড পরিস্থিতির কারণে মনেস্ট্রিতে এখন সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। এখানকার গ্রাম্য পরিবেশকে আরও বেশি করে উপলব্ধি করার জন্য এবং এখানকার মানুষদের সম্পর্কে জানার জন্য তিনচুলে থেকে তাকদা পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা আমরা পায়ে হেঁটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। কোলাহল হীন পরিবেশে  রাস্তার ধারে    মাঝে মাঝে একটা বা দুটো পাকা বাড়ি। প্রতিটা বাড়িই বিভিন্ন রকমের রঙিন ফুলে সাজানো। ওখানকার মানুষেরাও খুব আলাপি। পাহাড়ের গায়ে চেনা ,অচেনা গাছেদের সবুজের ছোঁয়া নিয়ে চোখ ও মনকে তৃপ্তি দিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম তাকদা। বেশ বড় জনপদ। ব্যাঙ্ক, এ টি এম, নিত্য প্রয়োজনিও সমস্ত রকমের জিনিসপত্রের দোকান আছে এখানে। 


        এখান থেকে দুই কিলোমিটার দূরে তাকদা অর্কিড সেন্টার ও পাঁচ কিলোমিটার দূরে ঝুলন্ত ব্রিজ অবস্থিত। স্বাধীনতার পূর্বে ব্রিটিশ আমলে তৈরী এই ব্রিজটি খুবই সুন্দর। প্রকৃতির মাঝে পাহাড়ি গ্রাম্য পরিবেশে দুটো দিন কাটানোর জন্য তিনচুলে আদর্শ জায়গা বলেই মনে হয়েছে। পরেরদিন সকালে তিনচুলেকে বিদায় জানিয়ে আমরা রওনা হলাম শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে। ফেরার পথে দেখে নেবো কয়েকটি দর্শনীয় স্হান। প্রথমে গেলাম এখান থেকে পনের কিলোমিটার দূরে তিস্তা বাজারের কাছেই অবস্থিত ত্রিবেনি ভিউ পয়েন্টে। এখান থেকে রঙ্গিত ও তিস্তার মিলিত হওয়ার দৃশ্য দেখা যায়। নদী দুটি ত্রিবেনি সঙ্গমে মিলিত হয়ে ভরা বর্ষার বৃষ্টির জলে পুষ্ট হয়ে আলপনা দিতে দিতে এগিয়ে চলেছে দূর দিগন্তের দিকে। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে সে যেন এক প্রাণ চঞ্চলা নারী। আমাদের পরের গন্তব্য ছিল লামহাট্টা ইকো পার্ক।



        কোভিড পরিস্থিতির কারণে পার্কটি বন্ধ থাকায় পরিচর্যার অভাব স্পষ্ট। পূর্বে এই পার্কটি খুবই সুন্দর ছিল। আকাশ পরিষ্কার থাকলে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কাঞ্চনজঙ্ঘা ও তার সন্নিহিত সমস্ত চূড়াগুলিকে এখান থেকেও খুব সুন্দর দেখা যায়। চলার পথের পাইন বনের সৌন্দর্য ও ছায়াপথ উপভোগ করবো এই আশা নিয়েই যাত্রা শুরু করেছিলাম মিরিক হয়ে ফিরবো বলে । লামহাট্টার পর থেকেই শুরু হল বেশ জোরে বৃষ্টি।জোরবাংলো, ঘুম, লেপচাজগৎ, সীমানা পয়েন্ট, পশুপতি গেট, মিরিক হয়ে বৃষ্টি ভেজা পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে এবং গোপাল ধারা টি এস্টেট ও তার পার্শ্ববর্তী  অঞ্চলের কার্পেটের মতো বিছিয়ে থাকা সবুজ চা বাগানের অপূর্ব দৃশ্য দেখতে দেখতে শিলিগুড়ি শহর কে ছুঁয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম এন জি পি রেল স্টেশনে। এবার আমাদের ঘরে ফেরার পালা।


পার্থ সারথী মণ্ডল
ঘোষ পুকুর লেন
সেগুন বাগান
পোস্ট কৃষ্ণনগর জেলা নদীয়া
মোবাইল নম্বর  ৭০০১৩২৩০৪৫


কিভাবে যাবেন- বাসে, ট্রেনে অথবা প্লেনে এন জি পি, শিলিগুড়ি অথবা বাগডোগরা পৌঁছে রিজার্ভ গাড়িতে অথবা শেয়ার গাড়িতে বা বাসে জোর বাংলো পৌঁছে সেখান থেকে শেয়ার গাড়ি অথবা বাসে তিনচুলে যাওয়া যায়।
কোথায় থাকবেন- তিনচুলেতে অনেক হোম স্টে আছে। যাওয়ার আগে বুক করে যাওয়াই শ্রেয়। কমবেশী বারশো টাকা প্রতিদিনের থাকা খাওয়ার খরচ।

কোন মন্তব্য নেই

Feature Post

সামনে এলো Galaxy A23 5G এবং Galaxy A13 5G এর স্পেসিফিকেশন। সম্পূর্ণ তথ্য আপনাদের জন্য।

      অবশেষে Samsung Galaxy A23 5G এবং Galaxy A13 5G স্মার্টফোনের দাম এবং কবে থেকে পাওয়া যাবে সেটা নিশ্চিত করেছে । দুটি স্মার্টফোনই তাইওয়ান...

Popular Post

fpm থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.
close