চড়াই উৎরাই পথে অনুসূয়া মন্দির ও অত্রি গুহা

 চড়াই উৎরাই পথে অনুসূয়া মন্দির ও অত্রি গুহা 




        অনেকদিন ধরে মনটা পাহাড় পাহাড় করছে । বারবারই মন বলছে এই এক ঘেয়েমির জীবন থেকে আমাকে মুক্তি দাও । কয়েকটা দিন পাহাড়ে ঘুরে এসো । কিন্তু অল্প দিনের জন্য কোথায় পাহাড়ে হাঁটতে যাওয়া যায় । " টিম রোডিস " পরিবারের বন্ধুদের সাথে আলোচনা করে ঠিক করা হলো এবার আমরা অনুসূয়া মন্দির ও অত্রি গুহা ট্রেকিং করতে যাবো । এই জায়গাগুলো সম্পর্কে আমার কোন পূর্ব ধারণা ছিলো না । আলোচনা সাপেক্ষে জানতে পারলাম হরিদ্বার থেকে দুশো পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে চামোলি জেলার অন্তর্গত মণ্ডল জনপদ , সেখান থেকেই ট্রেকিং শুরু করতে হবে আমাদের । 

        মণ্ডল গ্রামে থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে অনুসূয়া মায়ের মন্দির । এই মন্দির থেকে দুই কিলোমিটারের কিছু বেশি দূরে অত্রি গুহা । যাওয়া আসা মিলিয়ে চোদ্দ পনেরো কিলোমিটার পথ। রেলের তৎকাল পরিষেবার মাধ্যমে টিকিট কেটে নির্ধারিত দিনে ট্রেনে চড়ে বসলাম । শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে নিউ দিল্লি পৌঁছে সেখান থেকে ট্রেনে হরিদ্বার পৌঁছালাম দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যা বেলায় । হরিদ্বার পৌঁছালেই অন্য সব বাঙালির মতো আমার মনটাও কোন এক অজানা কারণে খুশিতে ভরে ওঠে । দাদা বৌদির হোটেলে রাতের খাবার খেয়ে দেবভূমি কে আবার দু চোখ ভরে দেখতে পাবো এই আনন্দ নিয়ে ক্লান্ত শরীরে হোটেলের নরম বিছানায় কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানিনা । পরের দিন ভোরে ঘুম থেকে উঠেই ছুটলাম হর কি পৌরি ঘাটের দিকে । তখনো শহরের মানুষের কর্মব্যস্ততা শুরু হয়নি । হাল্কা হিমেল হাওয়া গায়ে মেখে গঙ্গা র ধারে এসে দাঁড়ালাম ।



        বিভিন্ন মন্দির ও দেবতাদের মূর্তি দেখে মনের মধ্যে এক স্বর্গীয় অনুভূতি উপলব্ধি হতে থাকলো । আজকেই আমাদের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছাতে হবে মণ্ডল গ্রামে তাই তাড়াতাড়ি হোটেলে পৌঁছে প্রস্তুত হয়ে নিলাম । সকাল সকাল হরিদ্বার থেকে রওনা হয়ে পথের দুই ধারের প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখতে দেখতে এগোতে থাকলাম । রাস্তা সম্প্রসারণে কাজের কারণে ও পথের করুন অবস্থা যানবাহন কে তার আপন গতিতে চলতে দিচ্ছে না । যদিও দেবভূমির দেবতা ও মানুষের মধ্যে সংযোগকারী এই রাস্তায় সব বাঁধাই আমাদের কাছে তুচ্ছ মনে হচ্ছিল । হৃষীকেশ, দেবপ্রয়াগ , শ্রীনগর হয়ে চামলি তে অলকানন্দা কে অতিক্রম করে গাড়ি এগিয়ে চললো । সন্ধ্যা সাতটায় পৌঁছালাম মণ্ডল গ্রামে । ছোট্ট পাহাড়ি জনপদ, পাশ দিয়ে প্রচন্ড শব্দে বয়ে চলেছে পাহাড়ের বিভিন্ন ঝর্ণার একত্রিত জলের ধারা । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা এক সুন্দর পটভূমি এই জনপদ । 



        পরের দিন সকালে রওনা হলাম অনুসূয়া মায়ের মন্দির , অত্রি মুনির গুহা ও অত্রি গঙ্গার উদ্দেশ্যে । সিরোলি গ্রামের বিভিন্ন রকমের ফুলের গাছ দিয়ে সাজানো ছোট ছোট বাড়ীর পাশ দিয়ে বাঁধানো হাল্কা চড়াই পথে আমরা এগোতে থাকলাম। এইভাবে বেশ কিছুটা পথ চলার পরে শুরু হলো খাড়া চড়াই । বড়ো বড়ো নাম না জানা বিভিন্ন গাছের ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পাহাড়ের ঝর্ণার জলের শব্দে নিজের মনকে আন্দোলিত করে বনের পাখিদের কলরব শুনতে শুনতে প্রায় চার ঘন্টা প্রচন্ড চড়াই পথে চলার পরে আমরা পৌঁছে গেলাম অনুসূয়া মায়ের মন্দির প্রাঙ্গণে । 

        চারিদিকে বড় বড় পাহাড়ের মাঝে এক সুন্দর মনোমুগ্ধকর পরিবেশে এই মন্দির । অনসূয়া ছিলেন ঋষি কর্দম এবং দেবাহূতির কন্যা। কথিত আছে অত্রি মুনির পত্নী অনুসূয়া ছিলেন পতিব্রতা একজন সতী। স্বর্গরাজ্যের অধিবাসী সরস্বতী, লক্ষ্মী ও পার্বতী নারদের কাছ থেকে এই সতীত্বের কথা জানতে পেরে ঈর্ষান্বিত হয়ে তাদের পতি যথাক্রমে ব্রহ্মা‚ বিষ্ণু এবং মহেশ্বর কে মর্ত্যে পাঠিয়েছিলেন অনুসূয়া মায়ের পরীক্ষা নিতে । তিন সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশ ধারণ করে দেবতারা পৌঁছালেন অত্রি মুনির পর্নকুটিরে । সন্ন্যাসীরা তাদের অভুক্ত থাকার কথা জানিয়ে ভিক্ষাদাত্রী অনুসূয়া র কাছে নির্বাণ ভিক্ষা চাইলেন । অর্থাৎ ভিক্ষাদাত্রী কে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে খাদ্য পরিবেশন করতে হবে । এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে ও নিজের সতীত্ব রক্ষা করতে স্বামীর পদযুগল ধুইয়ে দেওয়া জল দিয়ে তিন জনকে শিশু তে পরিণত করে তাদের স্তনদুগ্ধ পান করালেন । নারদের কাছ থেকে স্বর্গের তিন দেবী তাদের স্বামীদের এই করুন পরিণিতির কথা শুনে মর্ত্যে ছুটলেন স্বামীদের ফিরিয়ে আনার জন্য । চিত্রকূট আশ্রমে গিয়ে অনুসূয়া র কাছে ক্ষমা চেয়ে তারা তাদের স্বামীদের অনুসূয়া র ইচ্ছাতে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর রূপে ফিরে পেলেন । 

        নিঃসন্তান অত্রিমুনি ও অনুসূয়া সন্তান প্রার্থনা করলেন তাদের কাছে । তখন তিন দেবতার সম্মিলিত রূপ হিসেবে জন্ম হল তিন মাথা‚ দুই পা এবং ছয় হাত সম্পন্ন এক শিশুর । তাঁর নামকরণ হল দত্তাত্রেয়। অনুসূয়া মন্দিরের কাছেই প্রখ্যাত ঋষি দত্তাত্রেয়ের মন্দির ।নিঃসন্তান দম্পতিরা সন্তান লাভের আশায় ও তাদের মনোস্কামনা পূরণের জন্য এখানে আসেন । এখান থেকে আমরা রওনা হলাম অত্রি মুনির গুহার উদ্দেশ্যে । পাহাড়ের ঢালে চারিদিকে গভীর অরণ্যের মধ্যে দিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম আমাদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। নানারকম পাখির কলরব ও ঝিঝি পোকার ন্যায় কোন পোকার আওয়াজ শুনতে শুনতে আমরা এগোতে থাকলাম। 

        এইরকম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভরা উৎরাই পথে বেশ কিছুটা পথ চলার পরে প্রচন্ড জোরে বয়ে চলা ঝর্ণার জলের শব্দ আমরা শুনতে পেলাম। আরো কিছুটা পথ গিয়ে আমরা শব্দের উৎস এক ঝর্ণার কাছে পৌঁছালাম। কাঠের তৈরি নড়বড়ে এক পাটাতনের উপর দিয়ে তীব্র গতিতে বয়ে চলা জলের ধারা কে অতিক্রম করে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। অত্রি গুহা র পাশে প্রচণ্ড শব্দে এক ঝর্ণা অত্রি গঙ্গা বেশ কিছুটা নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ছে । সে যেন প্রতিনিয়ত এক নৈসর্গিক দৃশ্যের সৃষ্টি করে চলেছে । এই মনোরম মায়াবী পরিবেশ ছেড়ে কিছুতেই ফিরতে ইচ্ছা করছিল না । চড়াই পথে অনুসূয়া মন্দিরের কাছে পৌঁছালাম। এখানে কাঠের তৈরি সুন্দর এক বাড়ীই ছিল আমাদের রাতের আশ্রয়স্থল । পরের দিন সকালে পাঁচ কিলোমিটার উৎরাই পথে মণ্ডল পৌঁছে আমাদের ট্রেকিং শেষ হলো । এবার আমাদের ঘরে ফেরার পালা ।


পার্থ সারথী মণ্ডল 
ঘোষ পুকুর লেন 
সেগুন বাগান 
পোঃ কৃষ্ণনগর
জেলা নদীয়া 
মোবাইল নাম্বার 7001323045


কিভাবে যাবেন:- ট্রেনে হরিদ্বার পৌঁছে সেখান থেকে বাস/গাড়ি তে মণ্ডল গ্রামে যাওয়া যায় ।

কোথায় থাকবেন:- মণ্ডল গ্রামে বেশ কিছু হোটেল আছে । অনুসূয়া তে কিছু হোম স্টে ও মায়ের মন্দিরে থাকার ব্যবস্থা আছে ।

কোন মন্তব্য নেই

Feature Post

সামনে এলো Galaxy A23 5G এবং Galaxy A13 5G এর স্পেসিফিকেশন। সম্পূর্ণ তথ্য আপনাদের জন্য।

      অবশেষে Samsung Galaxy A23 5G এবং Galaxy A13 5G স্মার্টফোনের দাম এবং কবে থেকে পাওয়া যাবে সেটা নিশ্চিত করেছে । দুটি স্মার্টফোনই তাইওয়ান...

Popular Post

fpm থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.
close